ছোটগল্প
রহস্যময় মহিলা
আধৃতি আইমিক
চাকরি সূত্রে আমার বাবা তখন মুর্শিদাবাদের কোনো এক ব্লকের বিডিও অফিসার। অবশ্য এইখানে বাবার খুব কম দিনই পোস্টিং ছিল। স্কুলের গণ্ডি তখনও পেরোইনি। পুরনো বন্ধুদের ছেড়ে আসার কষ্ট প্রতিবারই ঘটত।
জানেন প্রথম রাতেই আমাদের বাংলোয় অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটেছিল। খুব ছোটবেলার ঘটনা, তাই অনেক কিছুই ভুলে গেছি। তবু সেদিনের সেই অদ্ভুত ঘটনা স্মরণে আনছি। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমোতে যাব, হঠাৎ ছাদের পাটাতন থেকে শব্দ, ঠাস-ঠাস! কেউ যেন কাউকে ঘোড়ার চাবুক মারছে। হঠাৎ একটা মহিলার আর্তচিৎকার—এমন হৃদয় বিদারক রক্ত হিম করা কান্না, যা শুনে আমার শরীর শিউরে উঠল। শুধু আমি নই, বাড়ির সবাই সবটাই শুনেছে। মা, বাবা, আমার মেজো বোন—সবাই চমকে উঠে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি। বাইরে আটজন গার্ড পাহারা দিচ্ছে। বাবা তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কিসের শব্দ?” গার্ডরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, “স্যার, আমরা কেউ কিছু জানি না। এমন শব্দ আগেও শুনেছি, কিন্তু কিছু পাইনি।” বাবা সাহসী মানুষ। তাই দুজন গার্ডকে ছাদে পাঠালেন দেখতে। কিন্তু তারাও ফিরে এসে বলল, “কিছুই নেই। শুধু পাটাতনে কিছু দাগ ছাড়া কোথাও কিছু পাওয়া যায়নি।” শব্দটা কিন্তু থামল না। রাত গভীর হতেই আরও ভয়ঙ্কর কিছু শুরু হলো।
রাত তখন দুটোর কাছাকাছি। বিছানায় শুয়ে আছি, হঠাৎ মনে হলো কার যেন নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ের কাছে। ঠান্ডা, ভারী নিঃশ্বাস। গলায় যেন কার ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। আমার মেজো বোন, যে চিরকালই ভীতু, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার ঘরে এসে বলল, “দিদি, আমি তোর সাথে ঘুমাব।” ভয় না দেখিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, তুই ভয় পাস না, আয় দুই বোনে মিলে শিবের মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করে ঘুমিয়ে পড়ি।”
ওম ত্রয়ম্বকং যজামহে সুগন্ধিংপষ্টিবর্দ্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎ।।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। প্রায় প্রতি রাতেই একই ঘটনা। ছাদে চাবুকের শব্দ, মহিলার কান্না। কখনো গলায় ঠান্ডা হাত, কখনো নিঃশ্বাসের শব্দ। এক রাতে তো ঘটল এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড। শুয়ে আছি, হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন আমার গলার চিকন হাড়টা খুলে নিল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। সকালে উঠে দেখি, কার্পেটের ওপর আমার আর মেজো বোনের গলার হাড় দুটো পড়ে আছে! এত অল্প বয়সে এমন অস্বাভাবিক ঘটনা—ভয়ে বুক কাঁপছিল। মাকে সব খুলে বললাম। মা চুপ করে শুনে বললেন, “দেখি কী করা যায়।”
কয়েক মাস এভাবে কাটল। শীতকালে একদিন নিম্নচাপের প্রভাবে সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি আর ঠান্ডা বাতাস বইছিল। এরইমধ্যে রাত দশটার পর হঠাৎ করেই মা, মেজো বোন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাড়িতে আমি একা জেগে। একটা রহস্য গল্পের বই নিয়ে পড়ছি, কান সজাগ। হঠাৎ মনে হলো মা ডাকছেন। দৌড়ে গেলাম, দেখি তিনি অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। ফিরে আসতেই মনে হলো মেজো বোনের ডাক শুনলাম, গিয়ে দেখি সেও ঘুমাচ্ছে। এবার শুনলাম বাবার গলা। পরক্ষণেই মনে পড়ল বাবা তো দার্জিলিং এ ট্যুর করতে গেছেন।
শীতের রাতে আমার তখন দর দর করে ঘাম ঝরছে। এতবার কানে ভুল শুনব? নাহ্ এটা স্বাভাবিক নয়। বুকের ভেতরটা শিরশির করছে। নিজের মনেই বললাম, “ভয় পেলে ক্ষতি। তাই সাহস রাখতে হবে।” শিবের মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রটা বারবার জপ করতে লাগলাম। কিন্তু ভয়টা যে কিছুতেই কাটছে না। নিজের ঘরে ফিরে শুয়ে পড়লাম। মশারি টাঙাইনি, কারণ বারবার উঠতে হতে পারে। হঠাৎ মনে হলো কেউ আমার পায়ের কাছে বসল। লেপ দিয়ে মুখ ঢেকে ভাবলাম, “সবাই অসুস্থ, দরজা বন্ধ, গার্ড বাইরে—কে বসবে?” তবুও ভয়ে ভয়ের লেপটা একটু ফাঁক করে দেখি—একজন মহিলা! মাথায় ঘোমটা দেওয়া, আমার পায়ের কাছে বসে আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি, যেন আমার ভেতরটা দেখে নিচ্ছে। ভয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম।
“ভয় পেলে ক্ষতি। আমি ভয় পাব না,” বারবার বলছি আর সাথে সাথে শিবের মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রটা বারবার জপ করছি। সাহস করে একবার লাথি মারলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু ঠেকল না। হঠাৎ মনে পড়ল, অশরীরী জিনিসের আকৃতি থাকে, অবয়ব থাকে না। হাত-পা হিম হয়ে আসছে। লেপটা আবারও ফাঁক করে দেখি, মহিলাটা তখনও হাসছে। আমার ঘরের জানালা সবসময় খোলা থাকে। শীতেও একটা জানালা খোলা ছিল। জানালা দিয়ে গাব গাছটা দেখা যায়। বারবার জানালার দিকে তাকাচ্ছি, যদি গার্ডদের দেখতে পাই। কিন্তু কেউ নেই। সময় যেন থেমে গেছে। হঠাৎ ফজরের আজানের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে মহিলা উঠে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। গাব গাছের সঙ্গে মিশে গেল যেন। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। ভাবছিলাম জানালার রড ভেদ করে যায় কীভাবে?
উল্লেখ্য এলাকাটি ছিল মুসলমান এলাকা। তাই এখানে আজানের ধ্বনি কানে আসাটা স্বাভাবিক। মাঝখানে আমরাই কেবল হিন্দু। আশেপাশের লোকজন খুবই ভালো। মানে পরোপকারী। কোনো ধর্মীয় হিংসা নেই। বাবুর্চি কাকার সঙ্গে ভাব হয়েছিল। তাকে সব বলতাম। তিনি মাথা নেড়ে বলতেন, “হ্যাঁ, বাবুয়া, এসব এখানে ঘটে। এ বাংলোর পুরনো ইতিহাস আছে।” কিন্তু কী সেই ইতিহাস, তা কেউ খুলে বলত না।
সকালে সবার আগে মাকে রাতের ঘটনা খুলে বললাম। মা সব শুনলেন। তারপর বেলা হলে আর্দালিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন কোনো তান্ত্রিক পাওয়া যাবে কিনা। তখন আর্দালি বলল, তান্ত্রিক নেই তবে একজন ফকির বাবা আছেন, যিনি টাকা নেন না, কিন্তু সবার উপকার করেন। মা বললেন “ঠিক আছে এক্ষুনি আপনি উনাকে ডেকে আনুন।
কিছুক্ষণ পরে ফকির বাবা এলেন। মা সব খুলে বললেন। তিনি আমার কপালের দিকে তাকিয়ে আমার ঘরে গেলেন। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গাব গাছটার দিকে অনেকক্ষণ তাকালেন। কিছু আমল করে গাছে আর জানালায় ফুঁ দিলেন। আমাকে বললেন, “এশার পর জানালা বন্ধ রাখবে, ফজরের নামাজের সময় খুলবে। কেউ টোকা দিলেও খুলবে না।” মাকে বললেন, “ওই গাছের নিচে একটা মেয়েকে খুন করে পুঁতে রাখা হয়েছিল। তার দেহ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মেয়েটি ভয় পেলে ক্ষতি করত, কিন্তু আল্লাহর কালামের বরকতে তোমার বেটি রক্ষা পেয়েছে।” বাবা ফিরে এলে সব শুনে বললেন, “ফকির বাবা যা বলেছেন, তাই মেনে চলো।”
সেদিনের পর থেকে এশার পর জানালা বন্ধ রাখতাম। প্রতি রাতে জানালায় টোকা শুনতাম, কিন্তু খুলিনি। গলায় ঠান্ডা হাত, নিঃশ্বাসের শব্দ আর ঘটেনি। এতকিছুর পরেও ছাদে চাবুকের শব্দ আর মহিলার কান্না থামেনি।
এখন ২০১৯ সাল চলছে। এমএ পাশ করে চাকদহ কলেজে দীর্ঘদিন যাবত অধ্যাপনা করে সবে রিটায়ার করেছি। তবু সেই ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া বাংলোর সেই দিনের ঘটনা আজও ভুলতে পারিনি। ‘কী ছিল সেটা? চাবুকের শব্দটাই বা কার? কে ছিল সেই মহিলা? সত্যিই কি গাব গাছের নিচে কাউকে পুঁতে রাখা হয়েছিল?’ প্রশ্নগুলো আজও আমার অবচেতন মনে জাগে, ছটফট করে, কিন্তু উত্তর মেলে না, অজ্ঞাতই থেকে গেছে চিরকালের মতো। কারণ বড় হয়ে আর কোনোদিন ঐ বাংলোয় যায়নি।
_____________________
No comments:
Post a Comment